Onlyfan Premium Videos

অমাবস্যার চাঁদ (শেষ পর্ব)

 



গল্প:-অমাবস্যার চাঁদ -(শেষ পর্ব)

লেখক:আরভান শান আরাফ



নিলয় আর আমি হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছি৷ চারদিকে শিমুলের গাছ৷গাছের উপর নানান পাখির কিচিরমিচির ডাক, লাল ফুলে মনে হচ্ছে চারদিকে যেন আগুন লেগে আছে। আমি নিলয়ের মাথায় চুমু খেয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। আমি অবাক হয়ে নিলয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি নিলয় নেই৷ আমি একটা খুটি ধরে দাঁড়িয়ে আছি।আমি চিৎকার করে নিলয়ের নাম ধরে ডেকে উঠলাম৷ মাথাটায় আবারো চিনচিন ব্যথা৷ আমি হাসপাতালের বিছানায় শুয়া। আমার চিৎকার শুনে ছোটকা দৌড়ে এলো৷ গতরাতের গাড়ি এক্সিডেন্ট এর কথা আমার কিছু মনে নেই৷ শুধু মনে আছে আমি নিলয়ের খোঁজে বের হয়েছিলাম৷ 

আমি ছোটকার দিকে তাকালাম। ছোটকা ডাক্তার ডাকতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো। 

জমির কাকা ছুটে এলো। 

-বাজান,তোমার গেয়ান আয়ছে৷ আল্লার কাছে বহুত শুকরিয়া  

আমি ধীরে ধীরে বললাম

-নিলয় কোথায়?

জমিরউদ্দীন কাকা চুপ। আমি আবারো প্রশ্ন করলাম

-বলো কাকা,নিলয় কোথায়৷

জমিরউদ্দীন কাকা কিছু না বলে বের হয়ে গেল। আমি ক্লান্তবোধ করায় চোখ বন্ধ করলাম৷ 


হাসপাতাল থেকে এক প্রকার জোর করেই চলে এসেছি৷ বাসায় ফিরে সবার আগে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি খেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বিকেল প্রায় শেষ৷ গত তিন দিন ধরে আমার নিলয়ের কোন খোঁজ নেই ৷ আমাকে ছাড়া ও কোথায় আছে,কেমন আছে ভাবতেই বুকটা ভারী হয়ে যাচ্ছে৷ জমিরউদ্দীন কাকা খাবার প্লেট রাখতে রাখতে বলল

-আমার মন খুব খারাপ লাগছে বাজান৷ নিলয় বাজির কোন খবর নাই। 

আমি জমিরউদ্দীন কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম

-ওর বাপ চাচারা খোঁজ করেনি ওর।

জমিরউদ্দীন কাকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল

-গ্রামের সবাই তো বলাবলি করছে নিলয় কে ওর বাপে মেরে ফেলেছে 

কথাটা শোনার পর আমার সারা শরীর কেমন করে উঠলো৷ মনে হলো কেউ আমার হৃদয় কেটে নিয়েছে৷ 

জমিরুদ্দিন কাকা চলে গেল৷ আমি বিছানায় শুয়ে খানিক চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম৷ কী হয়েছে নিলয়ের, কোথায় আছে সে। 

কখন ঘুমিয়ে গেলাম জানি না। স্বপ্নে দেখি আমার নিলয় আমার সামনে দাঁড়িয়ে৷ ওর হাতে একটা পানির বোতল৷ সে পানির বোতলটা আমার হাতে দিয়ে বলল

-এটা খোলে দেন তো ডাক্তার সাব। বড্ড পিপাসা পেয়েছে৷ 

আমি বোতলটা খোলে ওর হাতে দিয়ে বললাম

-বোতল থেকে পানি খেতে হবে কেন?গ্লাসে করে খাও

নিলয় কিছু না বলে পানি খেতে লাগলো৷ হঠাৎ খেয়াল হলো ধীরে ধীরে নিলয়ের চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে৷ আমি নিলয়ের কাছে কিন্তু নিলয় কে দেখতে পাচ্ছি না৷ অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে সে৷ অমাবস্যার চাঁদের মত৷ 

আমি নিলয়ের নাম ধরে ডেকে জেগে উঠলাম৷ জমিরউদ্দীন কাকা দৌড়ে এলো। 

আমি পানি খেয়ে পড়নের কাপড় পড়েই ছুটলাম পুলিশ স্টেশন। এই থানার ডিসি,এসপি,ওসি সবাই আমার পরিচিত৷ থানার এসপি রফিকুল্লাহ আমার বন্ধু৷ তাকে বললে সে সাহায্য করবে। 


আজ চারদিন, নিলয়ের কোন খোঁজ নেই৷ আমি নিলয়ের বাবা সালামের নামে মামলা করেছি। জগত সংসারে সে ই একমাত্র ব্যক্তি যে নিলয়কে ঘৃণা করে।পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে৷ সালাম পলাতক। আমার বন্ধু রফিকউল্লাহর মতে সব কিছুর পেছনে সালামের হাত থাকতে পারে৷কিছুদিন আগে যেদিন নিলয় হারায়,তার দু'দিন আগে দলিলে স্বাক্ষর করার জন্য নিলয়কে মারধোর করেছিল৷ পরে নিলয়ের বড় কাকা এসে নিলয়কে বাঁচায়৷ এর পরের দিন সালাম বাড়ির সবার সামনে থ্রেট দিয়ে বলেছিল যে,যে কোন কিছুর মূল্যে তার সম্পত্তি লাগবে।মূলত সালাম ঋণে জর্জরিত ছিল৷ তাই সে সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য নিলয় কে জোর করত৷ বছর দুয়েক আগে একবার কিছু জমি বিক্রি ও করেছিল।কিন্তু নিলয় চায় তার দাদার সম্পত্তিতে তার দাদার নামে একটা এতিমখানা হোক৷ সম্পত্তির লোভ অপেক্ষা নিলয় অন্যদের কথা ভাবতো৷ তার দাদার বংশের একমাত্র বংশধর সে। সে চেয়েছিল যে ব্যক্তি তার মাকে সম্মান দিয়েছিল,তাকে জীবন দিয়েছিল তার নামটা টিকে থাকুক। সালামের অপকর্ম ঢাকা পড়ে যাক। নিজের বয়স অপেক্ষা অনেক মহত্ব ছিল তার আদর্শে৷ রফিকুল যখন নিলয়ের কথা বলছিলো তখন তার চোখে মুখে নিলয়ের প্রতি উপচে পড়া একটা স্নেহ কাজ করছিল৷ 


সন্ধ্যায় নিলয়দের বাড়ি গিয়েছিলাম।তাদের বাড়িতে পা দিতেই আমার ভেতরটা কেমন করে উঠলো। আমাকে ঢুকতে দেখে নিলয়ের কাকী দৌড়ে এলো৷ ওনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন৷ খাওয়া দাওয়া এক প্রকার ছেড়ে ই দিয়েছেন৷ এ নিয়ে দু'তিন বার সেন্সলেস হয়েছেন৷ আমাকে আসতে দেখে বিছানা থেকে নেমে এলেন৷ অবুঝ বালিকার মত প্রশ্ন করলো

-বাজান! আমার নিলয় কই গো? এত দিন ধরে আমার বাপজানের কোন খবর নেই। কেউ কোন খবর দিতে পারছে না। আমার মনে শান্তি পাচ্ছি না৷ তোমার কথা খুব বলতো৷ তুমি কি কিছু জানো। 

কাকীর প্রতিউত্তরে আমি কিছু বলতে পারিনি৷ কী বলব আমি?আমি নিজে ও তো আমার নিলয়ের খোঁজে আছি। ওকে ছাড়া আমার নি:শ্বাস আটকে যাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে জগৎ সংসারে আমার কেউ নেই৷ কিছু নেই। 

 

আমি নিলয়দের বাঁধানো পুকুর ঘাটে গেলাম৷ সেখানে হিজল গাছের ফুল ছড়িয়ে আছে চারদিকে৷ মনে হচ্ছে ঘাটের সিড়িতে যেন আগুন লেগে আছে৷পুকুরের শান্ত জল শ্যাওলা পড়ে সবুজ রঙে রাঙা হয়ে আছে৷ আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে খেয়াল করলাম পুকুরের অপর পাশে কদম গাছে এক জোড়া পাখি প্রেম আদান-প্রদান করছে। দৃশ্যটা দেখে আমার ভেতর ফেটে যাচ্ছিলো। আমার নিলয়কে আমার বুকে আগলে রাখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য তাকে আমার কাছে থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে । 

কিছুদিন আগে নিলয় বলেছিল, তার ছোট মনে আমার জন্য একটা রাজমহল গড়বে৷আমি সেই রাজমহলের একমাত্র রাজা৷ আমার নিলয়ের শখ ছিল ঘুরে বেড়ানোর, দেশটা দেখার৷ একদিন ফুটবল খেলায় হেরে মন খারাপ করে সন্ধ্যায় আমার  চ্যাম্বারে গিয়ে উপস্থিত৷ আমি তখন রোগী দেখায় ব্যস্ত৷ আমি ইশারায় আমার চেয়ারের পাশে বসতে বললাম৷ সে সেখানে না বসে ভেতরের রুমে গিয়ে শোয়ে মোবাইল টিপতে লাগলো আমি একবার চোখ বাঁকিয়ে ওকে দেখে বুঝতে পেলাম যে, আমার নিলয়ের মন খারাপ। দেখে মনে হচ্ছিল সারাদিন কিছু খাইনি৷ রোগী দেখা শেষে,আমার এসিস্ট্যান্ট মুশতাককে কিছু আনতে বলে ওর কাছে গেলাম৷ জিজ্ঞেস করলাম

-কী হলো নিলয় সাহেবের?

সে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ই বলল

-খেলায় হেরেছি। 

-কে জিতলো? 

-উত্তরপাড়া। 

-বাহ! আমাদের পাড়া। 

-আপনার আবার পাড়া আছেনি৷ কেউ তো জানে ই না যে আপনি আমাদের গ্রামের। গ্রামে তো যান ই না। আপনি বাস্তুহীন মানুষ। 

আমি নিলয়ের গালে হুট করে চুমু খেয়ে এক হাতে টেনে বুকের পাশে এনে বললাম

-তুমি থাকতে আমি বাস্তুহীন হব কেন?

নিলয় বাচ্চাদের মত প্রাণ খোলে হেসে উঠলো৷ ওর হাসিতে আমার সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়৷ মন আনন্দিত হয়ে যায়৷ আমি তাকে পেয়েছি। যার জন্য সারা জীবন ভরে এত নিসঙ্গতা ছিল তাকে পেয়েছি৷ 


চোখের কোণ ভিজে এলো৷ মনের অজান্তেই চোখে পানি চলে এসেছে। আমার হৃদয় দিয়ে যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে তিনদিন ধরে চোখে দেখি না।হুশ এলো নিলয়ের কাকার কথায়

-বাজান,পুলিশ সাব এসেছিল। একবার এসো ত। 

আমি ওনার দিকে তাকালাম। শান্ত একটা চেহারা। অন্যের ছেলেকে বুকে আগলে রেখে বড় করেছেন এই ভদ্রলোক৷ আমার মত ওনারা ও নিলয়ের জন্য কাতর৷মনে মনে কয়েকবার নিলয়ের নাম ধরে ডাকলাম

-ফিরে এসো নিলয়৷ সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে৷  


রফিকুল্লাহ চেয়ারে বসা। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো৷ আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে আমার হাতে একটা কাগজ এগিয়ে দিল৷ সালাম আর তার সাথের দুই অনুচরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পেপারে তাদের জবানবন্দি ছাপা। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে পেপারটা  নিলাম। জবানবন্দি পড়ার সময় আমার মনে হচ্ছিল আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে৷ আমি অচেতন মনে জোরে জোরে পড়ছিলাম। 

পুবের বনের কোথাও নিলয়ের লাশ মাটিতে পুঁতে রেখেছে৷ এই লাইনটুকু পড়ার পর আর কিছু মনে নেই৷ ঘরের ভেতর থেকে নিলয়ের আম্মু,কাকী আর অন্যদের কান্নার শব্দ শুনছিলাম৷ চোখ ঝাপসা৷ মাথাটা কেমন যেন করে উঠলো। আমি জ্ঞান হারিয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে গেলাম। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো,জগত সংসারে আমার আর কিছু নেই৷ সব পুড় ছাই হয়ে গেছে। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা৷ ভয়াবহ যন্ত্রনা। কে যেন বুকে প্রচন্ড ভারী কিছু চাপা দিয়ে রেখেছে। 


দু দিন পর আমি কিছুটা,স্বাভাবিক হলাম। ব্রেইন স্ট্রোক করেছিলাম। এই দুই দিনের কোন কিছু আমার মনে নেই৷ বা পাশের হাত আর মুখ অবশ হয়ে আছে৷ আমার বন্ধু ড:জেরিন কে খুব চিন্তিত দেখলাম৷ সে সুনামধন্য নিউরো-সার্জন। তার মুখে চিন্তা মানাচ্ছিল না৷ আমার ছোটকা আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলছিল

-তুকে বাহিরে নিয়ে যাব দু-দিনের মধ্যে৷ তুই সুস্থ্য হয়ে ফিরবি দ্রুত। বাজানরে, তুই ছাড়া কে আছে আমাদের? 

বলেই তিনি কান্না শুরু করলেন। 

 আমি একটা খাতায় নিলয়ের কথা লিখলাম৷ সে কোথায়? 

ছোটকাকে দেখলাম নিলয়ের কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি তার একটা হাত ধরে কেঁদে উঠলাম। কাকা কী বুঝলো জানি না, তিনি ড:জেরিনের কাছে জিজ্ঞেস করলো আজকের জন্য আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে কিনা৷ 

 

আমি হুইল চেয়ারে বসে নিলয়দের বাসায় এলাম। সারা এলাকার মানুষের ঢল নেমেছে তাদের বাড়ি। পুকুর পাড়ের হিজল গাছের নিচে নিলয়ের খাটিয়া রাখা৷ পোস্ট-মর্ডাম করা আমার নিলয়ের কোমল শরীরটা এই খাটিয়াতে পড়ে আছে৷ বাড়ির ভেতর থেকে মানুষের রোদনের শব্দ ভেসে আসছে৷ একজন বৃদ্ধা কাঁপতে কাঁপতে নিলয়ের খাটিয়ার সামনে গিয়ে কান্না করছে৷ 

-ভাইরে!এহন কে আমুইরে চিড়ে গুড় কিনে দিবে। ভাইরে! তুই আমায় নিয়া গেলি না কুনেরে।

আমার ভেতর কেঁদে উঠলো। এই বৃদ্ধাকে ই ঐ দিন নিলয় টাকা দিয়েছিলো। 

হিন্দু পাড়া থেকে কতক মহিলা পুরুষ এসেছে দেখলাম।নিলয়ের খেলার সাথী,পাড়ার বন্ধু বান্ধব,কলেজের বন্ধু,কতক শিক্ষককে ও দেখলাম৷ সবার চোখে পানি৷ 

আমার ছোটকা অবুঝ বাচ্চাদের মত ঘন ঘন চোখের পানি মুছছেন৷ বড় স্নেহ করতেন তিনি নিলয়কে।আমার এসিস্ট্যান্ট আমার পাশে ফিসফিস করে বলল

-স্যার দেখছেন,কত্ত মানুষ। 

আমি ইশারায় ওকে চুপ করতে বললাম৷আমার চোখে কোন পানি নেই৷ নিলয়কে হারানোর যে ভয়াবহ ব্যথাটা ছিল সেটা ও নেই। মনে হচ্ছে,নিলয় আমার পাশে ই আছে। অথবা দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে।

একটু পরে ই ছোটে আসবে৷ এসে বলবে

-ডক্টর সাব, একশো টাকা দেন তো। 

আমি এক হাতে আমার পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলাম। 

সেকি! ওয়ালেট আনিনি। আমার নিলয় টাকা চায়লে কোথা থেকে দিব?

হুশ এলো নিলয়ের মামার কান্নার শব্দে। এই বাড়ি থেকে একদিন এই লোকের বোনের খাটিয়া উঠেছিল৷ আজ তার বোনপুত্রের৷ নিয়তি খুব কঠিন খেলা খেলছে তাদের সাথে। ওনার করুণ আহাজারি আমার মনোবল নাড়িয়ে দিচ্ছে। 

নিলয়ের কাকাকে দেখলাম বারান্দার একটা চেয়ারে শান্তভাবে,প্রাণহীন মূর্তির মত বসে আছে৷ ওনার উদভ্রান্ত চোখের দিকে তাকালে যে কারো মন গলে যাবে৷ পরের ছেলেকে বুকে আগলে লালন করে, আজ এই দুর্বিষহ দিন অতিবাহিত করতে হবে কে জানতো। 

আমি কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব জানি না৷ কিন্তু এই মানুষগুলোর জন্য ও আমার হৃদয় কাঁদছে৷ তারা যে আমার নিলয়ের ই একটা অংশ। 


নিলয়ের কবর হয়েছে তার মায়ের কবরের ঠিক পাশে৷ বকুল গাছের নিচে৷এই কবরস্থানে কারো কবর বাঁধানোর নিয়ম নেই৷ কিন্তু ছোটকা নিলয়ের কবরটা উচু করে বাধিয়ে দিয়েছে।গ্রামের কেউ কেউ দেখলাম ফুলের চারা এনে লাগিয়েছে কবরের চারপাশে। আমি সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে ছোটকার সাথে হুইল চেয়ারে বসে নিলয়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারিনি৷ ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রনায় জ্বলে যাচ্ছিলো। আমি কী করে নিলয়কে ছাড়া বেঁচে থাকব৷ এত কাল একা ছিলাম৷ মা-বাবা ছাড়া একা একা বড় হয়েছি। নিয়তির কাছে পরাজিত হয়ে অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছি। বাবাকে হারিয়েছি। সব কিছু ভুলে ছিলাম নিলয়কে কাছে পেয়ে৷ আজ সে ও নেই৷ আমি আবার একা হয়ে গেলাম। আমার জীবন অমাবস্যার চাঁদের মত গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেলো। 


সিঙাপুরের মাউন্ট ই হসপিটালের ডাক্তারদের অপ্রাণ চেষ্টায় প্রায় এক বছর পর আমি সুস্থ্য জীবনে ফিরে এসেছি। আমার বন্ধু ড: জেরিন দিনরাত এক করে দিয়েছিল আমাকে সুস্থ্য করার জন্য। সেদিন যখন প্রথম মাটিতে পা রাখি তখন সারা শরীরের বিদ্যুৎ খেলে গেলো। মনের আনন্দে জেরিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। নিলয়ের কবরের সামনে ও যে চোখের জল পড়েনি আজ সেই চোখের জলে মনের যন্ত্রনা ভেসে গেলো। 



সেদিন রাতে নিলয়কে স্বপ্নে দেখে চিৎকার করে জেগে উঠলাম৷ পানি খেয়ে বিছানায় গিয়ে কল্পনা করছিলাম দুজনের এই দুরত্বের স্বরূপ৷ সে তার মায়ের পাশে,বকুল গাছের নিচে চিরনিদ্রায় আর আমি আধুনিক এক শহরে যান্ত্রিক জীবনে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর লড়ায়ে ব্যস্ত। জানি না কোন দিন তার প্রেম ভুলে নতুন করে বাঁচতে শিখব কিনা৷ 

আজকাল দেশে ফিরতে মন চাই না৷ বড়কা মারা গেলেন এক সপ্তাহ হলো। ছোটকার ও শরীর ভালো না। সুস্থ্য হওয়ার পর আমি এখানকার একটি মেডিক্যাল কলেজে এডমিশন নিয়েছি হার্ট স্পেশালিষ্ট হতে।সারাদিন টানা ক্লাস,হসপিটাল,ব্যস্ততা শেষে যখন বাসায় ফিরি তখন নিলয়ের চেহারাটা ভেসে উঠে। মনে হয় নিলয় আমার কাছে ই আছে৷ রাত হলে আমার বুকে মাথা রেখে বাচ্চাদের মত ঘুমায়৷ সম্পত্তির লোভে ওর জন্মদাতা ওর বুকে ছুরি মেরে হত্যা করেছিল। তার ফাঁসি হওয়ার পর যখন লাশ গ্রামে পাঠালো তখন গ্রামের লোকজন তাকে গ্রামে কবর দিতে বাধা দিল৷ পুলিশ বাধ্য হয়ে খালপাড়ে বেওয়ারিশ কবরস্থানে কবর দিল তাকে। সে তার পাপের ফল পেয়েছে। কিন্তু,আমি হারিয়েছি আমার নিলয়কে। 

সেদিন ছোটকা কুরিয়ারে করে নিলয়ের কিছু জিনিস পাঠালো৷ তাতে ছিল একটা ডায়রি৷ তার উপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা-ডক্টর সাব। 

সে হয়ত ডায়রিটা আমার জন্য ই নিয়েছিল। আমাকে নিয়ে তার মনের কথাগুলো লিখার জন্য৷ 

ডায়রির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা-

      কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

      যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

      মরিবার হ’লো তার সাধ;

কবিতার লাইনটা পড়ে আমার চোখের পানি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে ডায়রির উপর পড়ল। 

ভেতর থেকে একটা যন্ত্রনাময় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজেকে কোনভাবে সামলে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। 

এই আধুনিক যান্ত্রিক শহরে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রেমহীন,ভালবাসার মানুষহীন হয়ে। আমার জীবন ঢেকে গেছে অন্ধকারে। যে চাঁদের আলো আমার জীবন আলোকিত করার কথা সে রয়ে গেছে অমাবস্যার বন্ধনে।নিলয়!আমার নিলয়,কেন তুমি আমাকে এভাবে একা করে দিলে। কেন সেদিন আমি তোমাকে আটকে রাখিনি। কেন তোমাকে আমি দুনীয়া থেকে আড়াল করে রাখিনি৷ কেন সব এভাবে নষ্ট হয়ে গেল। 

...............(সমাপ্ত)।  


সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ যারা আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন। যারা কমেন্ট করে অনুপ্রাণিত করেছেন তাদেরকে ও ধন্যবাদ। আশা করি এভাবেই পাশে পাব সবাইকে। 

অমাবস্যার চাঁদ (শেষ পর্ব) অমাবস্যার চাঁদ (শেষ পর্ব) Reviewed by সমপ্রেমের গল্প on February 25, 2023 Rating: 5

2 comments:

  1. 🙁 I'm speechless 😶

    ReplyDelete
  2. অমাবশ্যার চাঁদ স্টোরির যে এরকম এন্ডিং হবে ভাবতেই পারি নি আগে 😶

    ReplyDelete

Powered by Blogger.