গল্প:-অপ্রেমের কাব্য
পর্ব:-১
লেখক:-আরভান শান আরাফ
বাড়ি ভরা মেহমান, মুহিনের বড় বোন সুবর্ণার বিয়ে। যার সাথে বিয়ে সে উপজেলা শিক্ষা অফিসার৷ বড় ভালো বিয়ে৷ বর একটু কালো,খাটো,তার আগের একটা বিয়ে হয়েছিল। মুহিনের বাবা এসব দেখেনি৷ দেখেছে ছেলে ভালো৷ সরকারি চাকরি করে।
মুহিনের ছেলে একদম পছন্দ হয়নি৷ কিন্তু তার বাবা মায়ের পছন্দ বলে কথা।মুহিন সুবর্ণার বড় স্নেহের।সে তার ভাইকে সর্বদা চোখে হারায়৷ আজ সুবর্ণার গাঁয়ে হলুদ। সকাল থেকে মুহিনের খবর নেই।একমাত্র বোনের বিয়ে তার উচিত বাড়িতে থাকা৷ কিন্তু সে লাপাত্তা৷ মুহিনের দু তিনজন বন্ধুকে নানান কাজে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তারা ও জানে না মুহিন ঠিক কোথায়। সুবর্ণাকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে দুজন মেয়ে এসেছে। তারা পরস্পরের মধ্যে মুহিনকে নিয়ে কথা বলছিল। সুবর্ণা চুপচাপ বসে আছে। সে তার ভাইয়ের জন্য পাজামা,পাঞ্জাবি এনেছিল। সেটা দেওয়া হয়নি৷ গতরাতের খাবার টেবিলে মুহিন একটা কথা ও বলেনি৷ সুবর্ণার মনে হলো,মুহিনের মন খারাপ।
ফুলেশ্বরী নদীর ঘাটে সাড়ি সাড়ি নৌকা।মুহিন বিকেল থেকে নৌকার ছাদে শুয়ে আছে৷ সাথে তার দু তিনজন বন্ধু৷ এর মধ্যে একজন জীবন।তাদের মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে । বাকিরা চুপ।
-হে রে মুহি,বাসায় যাবি না?আজ না আপার গাঁয়ে হলুদ৷
-নাহ! যাব না।
-কেন যাবি না?
-এমনি৷ তুকে বলব কেন?
জীবন চুপ হয়ে গেল। কথা বলল শরতে।
-চল সবাই শহরে যায়। সিনেমা দেখে আসি। খুব ভালো সিনেমা চলছ. ।
বাকিরা কিছু না বলে চুপ করে আছে দেখে শরতে আবার বলল
-কিরে! যাবি কিনা বল।
মুহিন শোয়া থেকে হুট করে উঠে বলল
-চল।
মুহিনের মনোভাব বুঝা কঠিন। জীবন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো।। জীবনের এখন ঠিক সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছিল না,তার মন চাচ্ছে মুহিনের আপুর গাঁয়ে হলুদে যেতে।
তারা যখন সাইকেল নিয়ে গ্রাম ছেড়ে উপজেলা শহরে পৌঁছালো তখন রাত নয়টা। সারা শহরে থমথমে পরিস্থিতি। দোকানপাট সব বন্ধ৷ এখানে ওখানে পুলিশ টহল দিচ্ছে। পোড়া গন্ধ। শরত প্রশ্ন করলো
-কিরে,কিছু কি হয়েছে?
জীবন ঘাবড়ে ছিল৷ সে আরো ঘাবড়ে গিয়ে বলল
-এই মুহিন,কিরে -চল চলে যাই৷ আমার কেমন যেন লাগছে৷
মুহিন কিছু না বলে সাইকেল নিয়ে সামনে এগুতে লাগলো৷ ঠিক সেই সময় এক দল লোক কোথা থেকে যেন ছুটে এলো৷ তাদের হাতে ইট,পাথর,গাছের ডাল। শরত আর জীবন সাইকেল নিয়ে উলটো দিকে চলল৷
কিন্তু মুহিন ভিড়ের মিশে গেল।
হঠাৎ করে মুহিনের হুঁশ হলো। এটা যে সরকার বিরোধী কোন মিছিলের কুফল সেটা বুঝতে তার খানিক সময় নিল৷ আর যখন সময় নিল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ মুহিন সাইকেল রেখে উল্টো দিকে দৌড়ে এক বাসায় গিয়ে ঢুকলো। দু'তলা বাড়ির ছাদে কারা যেন মিটিং করছিল৷ মুহিন ভয়ে চুপচাপ প্যান্ডেলের নিচে একটা খালি চেয়ারে গিয়ে বসলো৷ কিন্তু ভাগ্য উলটো স্রোতে চলল। সে দেখলো একজন পাজামা পাঞ্জাবি পড়া লোক তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভয়ানক রাগি চেহারা৷ তার আগে পিছে তিন চারজন ছেলে পুলে৷ মুহিনের দিকে ইশারা করে বলল
-এটাকে ধরে নিয়ে পুলিশে দে৷ ছোটলোকের বাচ্চা আন্দোলন করবে,বোমা ফাটাবে৷
মুহিন ভয়ে কাঁপছিল৷ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
-আমি এসবে নেই৷ আমাকে যেতে দেন।
লোকটা এক হুংকার মেরে বলল
-চুপ, একদম চুপ। এই সোহেল! ধর এটাকে
মুহিন এবার কেঁদে দিল
-প্লিজ স্যার। আমার বোনের বিয়ে আজ৷ আমাকে সেখানে যেতে হবে। আমাকে পুলিশ দিবেন না।
মুহিন অনেক হাত জোড় করলো। কিন্তু এই লোক শুনলো না৷ রাগে দাঁত গিজগিজ করতে করতে মুহিনকে পুলিশে দিয়ে দিল।
ভদ্রলোকের নাম ইজহার মাহমুদ। হোসেন মাহমুদের ছেলে৷ হোসেন মাহমুদ এই জেলার মেয়র ছিলেন। ওনি মারা যাওয়ার পর পুন:নির্বাচনে ইজহার মাহমুদ বিজয়ি হওয়ার পর বিরোধী পার্টি নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করে এখানে ওখানে দাঙ্গা ফ্যাসাদ করে যাচ্ছে৷ হোসেন মাহমুদ নেতা হিসেবে যতটা শান্ত আর জনদরদী ছিলেন ইজহার মাহমুদ তার বিপরীত। তার অধিক রাগ,উগ্র মেজাজ আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি তাকে উৎকৃষ্ট রাজনিতিবীদে পরিণত করেছে৷ বত্রিশ বছর বয়সে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
ভবিষ্যতে সে সংসদ নির্বাচন করবে এমনটা অনেকের ভাবনা৷ সুদর্শন,তরুণ,প্রাণবন্ত নেতা হিসেবে ইজহার মাহমুদের নাম মুখে মুখে৷ জগত সংসারে সে তার মা ব্যতিত অন্য কারো কথা মানে না৷ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পত্রিকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা প্রচারিত হলে ও,তার ব্যক্তিগত জীবন তার মা আর ছোট বোন ইশা কে কেন্দ্র করে ই চলমান৷
মুহিন শান্ত হয়ে জেলের ভেতর বসে ছিল। জেলের কামরাটা বেশ ছোটখাটো। গাদাগাদি করে অনেক গুলো মানুষকে ঢুকিয়েছে৷ দু' তিন জন মহিলা ও ছিল৷ মহিলাদের কামড়া আলাদা হওয়ার কথা। কিন্তু,সেটা বন্ধ হয়ে আছে৷ তাই মহিলাদের পুরুষ কামড়াতেই ঢুকানো হয়েছে৷ তাদের মধ্যে একজন মাঝ বয়সী মহিলা৷ পান খেতে খেতে আশেপাশের মানুষদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল।মুহিন কে দেখে বলল
-এই পোলা,তোমারে ধরলো কেন?তুমি কি আমাদের পার্টি কর৷
মুহিন মহিলার মত করে ই হাসি হাসি মুখে বলল
-জ্বি৷ আমি আপনাদের পার্টির ই।
-অ আল্লাহ!তুই কার ছেলেরে?এত সুন্দর পোলা,জেলে।
এই মোবারইক্কা৷ এই হারামজাদা। ওরে ধরছে কে?
একজন পুলিশ গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো৷ কাচুমাচু করে বলল
-কী আপা।কী বলছিলেন?
-এই ছেলেরে কে ধরলো?
-ওরে তো ইজহার মাহমুদ স্যারের অর্ডারে ধরা হয়ছে।
মহিলাকে চিন্তিত মনে হলো। সে তার বুকে রাখা ব্যাগ থেকে একটা পান বের করে মুখে দিয়ে বলল
-দাঁড়া বাছা,তুকে বের করার একটা ব্যবস্থা করছি।
মুহিন দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে বসে ভাবতে লাগলো তার বোনের কথা৷ এত রাত হয়ে গেছে৷ তার থাকা উচিত ছিল বোনের গাঁয়ে হলুদে। কাল তার বোনের বিয়ে। অথচ সে এখন জেলে। বাসার আর কেউ চিন্তা না করুক, তার সুবর্ণা আপু হয়ত চিন্তা করছে৷ গত মাসে ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা শেষে সে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল৷ রাস্তায় মোবাইল অফ হয়ে যাওয়াতে সুবর্ণা চিন্তা করে মাথা ব্যথায় অসুস্থ্য হয়ে গিয়েছিল৷
রাত গিয়ে সকাল৷ মুহিনের কোন খবর নেই৷ মুহিনের বাবা জনাব শিকদার সারা রাত্রি নানা কাছে ব্যস্ত ছিলেন তাই ছেলে বাড়ি ফিরেছে কিনা তার খবর নিতে পারেননি৷ তার স্ত্রী একটু বোকাসোকা ধরনের মহিলা। সে নিজের মেয়ের বিয়েতে সাজুগুজু নিয়ে ব্যস্ত। ছেলে কোথায় আছে তার চেয়ে অধিক চিন্তার বিষয় কাল কী পড়বে,কোথায় সাজবে সেটা নিয়ে।সুবর্ণা বারবার তার মাকে ডেকে পাঠিয়েছে কিন্তু তিনি ব্যস্ত।
সকালে সবাই যখন তেহারি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত তখন মুহিনের মায়ের মনে পড়ল ছেলের কথা৷ সে গিয়ে শিকদার সাহেবকে ভয়ে ভয়ে বলল
- সুবর্ণার আব্বা,শুনেন না । মুহিন রাতে বাসায় ফিরেনি৷
শিকদার সাহেব বিছানার বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলেন৷ শোয়া থেকে ই জবাব দিল
-না আসুক৷ ওর যা ইচ্ছে তা করুক।
মিসেস শিকদারের মন বিষণ্ণ হয়ে গেল৷ তিনি মাথায় কাপড়টা টেনে জীবনের বাসায় চলে গেল৷ জীবন তখনো ঘুমে। সে গতকালকের ঘটনার কথা জানালো। সব বলার পর সে বলল
-মুহিন, কি রাতে আসেনি কাকী?
মুহিনের মা ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে আবার বাসায় ফিরে শিকদার সাহেবকে সব বলল। সব শুনার পর ওনার টনক নড়ল। তার কপালের ভাজে চিন্তা দেখা দিল৷
অল্প সময়ের মধ্যে ই সারা বাড়ি ছড়িয়ে গেল, মুহিনকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে গতকাল থেকে নিখোঁজ।
যে যেভাবে পারে ফোনে যোগাযোগ করেছে৷ নিকট আত্মীয় সব এখানে ই। তাই আর নিকট আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করেনি।
সুবর্ণা শাড়ি, গহনা কিছুই না পড়ে সমানে কেঁদে যাচ্ছে৷ ওদিকে বর যাত্রী আসার সময় হয়ে গেছে।বিয়ে বাড়ির উৎসব পরিণত হয়েছে বিষণ্ণতার মহলে।
মেয়র ইজহার মাহমুদের মন অস্থির হয়ে আছে৷ সে তার মায়ের কুলে মাথা রেখে শুয়ে আছে৷ তার মা এক হাতে তসবীহ জপছে আর অন্য হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছে। গতকাল রাতের কথা ভেবে তার মন বিষণ্ণ। ২০/২১ বছরের একটা ছেলে রাজনিতীতে জড়িয়েছে৷ গতকাল রাগে তাকে হয়ত সে জেলে দিয়েছে ঠিক কিন্তু এখন মনে হচ্ছে,কাজটা একদম ঠিক হয়নি৷ ইজহার মাহমুদ হাতে ফোনটা নিল৷ পুলিশ অফিসারকে একবার ফোন করা যেতে পারে। পরক্ষণে কী মনে করে যেন ফোনটা রেখে দিল৷ না থাক৷
মুহিন মনে মনে হাজারটা গালি দিচ্ছে ইজহার মাহমুদকে৷ ইজহার মাহমুদ মুহিনের কথা ভাবছে। তার মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে৷ কিন্তু সেই ভুল শোধরাতে ও চাচ্ছে না। থাকুক কিছু ভুল। হোক কিছু ভুল।
মুহিন আজকে ও জেলে৷ আজ কোর্ট বন্ধ৷ তাই কাউকে ই আদালতে নেওয়া হয়নি৷ দু একজন ইতোমধ্যে ছাড়া পেয়েছে৷ জেলে হালকা পাতলা ধরনের মাঝ বয়সী লোক ছিল। সে রুটি আর ডিম ভাজি আনিয়েছে৷ নিজে খাচ্ছে আর বারবার মুহিনকে বলছে
-নেও বাপ। একটা রুটি খাও৷ কাল রাইত থেকে ত কিচ্ছু খাও নি।
মুহিন একটু রুটি নিলো ঠিক ই কিন্তু তা আর গলা দিয়ে নামছে না। চিবিয়ে যাচ্ছে। তার মন বাড়িতে পড়ে আছে৷ কে জানে,সেখানে কী চলছে।
সে রাগ করে চেয়েছিল বাড়ি থেকে দূরে চলে যাবে আজ সে সত্য সত্য ই দূরে। তিন দিন পর তার ইউনিভার্সিটি টেস্ট। তার প্রচুর পড়াশোনা করা দরকার কিন্তু সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। ইজহার মাহমুদের মত নেতার জন্য সে বিনা দোষে জেলে।
দিন গড়িয়ে দুপুর৷ মেহমানদের খাবার দেওয়া হচ্ছে৷ বর যাত্রী এসেছে কিন্তু সুবর্ণাকে বার বার বলে ও সাজানো যাচ্ছে না৷ সে টানা কেঁদে যাচ্ছে। মুহিনে মা এখন সাজু গুজুরগুজুর কথা ভুলে সমানে কাঁদছে। এর মধ্যে কাউন্সিলর সাহেব মুহিনের বাবাকে কানে কানে এসে কী যেন বলল। কথা শুনে মুহিনের বাবা ঘর থেকে বের হয়ে গেল৷ মুহিন যে জেলে এই খবরটা যে কোন ভাবে হোক কাউন্সিলর সাহেব জানতে পেরেছে৷ কিন্তু সে ততটা ও নিশ্চিত নয়৷
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বর এলো৷ সে বাড়িতে পা দিয়ে সব শুনলো। মাথার পাগড়িটা গাড়িতে রেখে গলার মালাটা খোলে রেখে সে ও ছুটলো পুলিশ স্টেশন৷
মুহিনের ছাড়া পেতে ঘন্টা খানেক লেগেছে। মুহিন বসে আছে নতুন জামায়ের পাশে। সে চুপচাপ৷ নতুন বর ও চুপচাপ। ড্রাইভারের পাশে বসে টানা কথা বলে যাচ্ছেন। কথা না,মুহিনের খাম খেয়ালিপনা নিয়ে বিশেষ বক্তব্য৷ মুহিন এসব শুনে অভ্যস্ত। তাই তার বাবা কী বলছে তাতে খেয়াল না করে ড্রাইভারকে বলল
-ড্রাইভার সাব,গান চালান তো।
মুহিনের বাবা রাগে দাঁত কামড়ে বলল
-সারা রাত জেলে কাটিয়ে এখন আয়ছে গান শুনতে৷ চুপ করে বসে থাক৷
-জেলে রাত কাটালে গান শুনা যাবে না কেন?আমি তো শুনব ই৷
-চুপ, একদম চুপ৷থাপ্পড় মেরে সোজা করে দিব।
-আমি তো সোজা ই।
মুহিনের বাবা বরের দিকে তাকিয়ে বলল
-দেখলে তো বাজান। কত বড় বেয়াদব ছেলে আমার। বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক। তারপর ওকে সোজা করব।
নতুন বর মুচকি হেসে বলল
-থাক বাদ দিয়ে দেন আব্বা।ছেলে মানুষ। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে৷
মুহিন একবার ওর দুলা ভাইকে দেখলো৷ নাহ! বেশ ভালো মানুষ তার দুলাভাই। তা নাহলে কি বিয়ের দিন ই এভাবে সাহায্য করতো।
সুবর্ণার বিয়ের দু দিন পরে স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরিক্ষা৷ মুহিন সারা রাত্রি জেগে পড়েছে৷ ভোর রাতে ঘুমের জন্য বিছানায় পিঠ লাগানোর পরেই তার মা এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। মুহিন চোখ কচলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নয়টা বাজতে বিশ মিনিট বাকি৷ পরিক্ষা শুরু দশটা থেকে। মুহিন লাফিয়ে উঠে, পাজামার সাথে টি শার্ট পড়ে সাইকেল নিয়ে ছুটল পরিক্ষা দিতে৷ তার মা তার পিছে ছুটলো প্রবেশ পত্র আর পরোটা নিয়ে৷
-হেরে মুহিন!প্রবেশ পত্র নিয়ে যা৷
মুহিন ফিরে এসে এক হাতে প্রবেশ পত্রটা নিল অন্য হাতে একটা পরোটা। মুহিনের মা বিড়বিড় করতে করতে বাড়ি ফিরলো।
নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে মুহিন পরিক্ষা হলে প্রবেশ করলো ঠিক৷ কিন্তু এমন উদ্ভট ড্রেসাপ দেখে তার বন্ধু বান্ধবের মুখ হা হয়ে গেল।
মুহিন তখন পরিক্ষার হলে মনোযোগের সাথে পরিক্ষা দিচ্ছিল৷ ঠিক তখন ম্যাজিস্ট্রেট আর সাথে ইজহার মাহমুদ ঢুকলো৷ মুহিন একবার চোখ তুলে তাকালো৷ মনে মনে কয়েকবার ইজহার মাহমুদকে গালি দিল৷ তার গোষ্ঠীর তুষ্টি করে যখন টেস্ট মনোযোগ দিল তখন তার মনে হলো, ইজহার মাহমুদ তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ সে খাতা থেকে মাথা তুলে ইজহার মাহমুদকে আরেক বার দেখে আস্তে আস্তে গালি দিল
-ভন্ড, শয়তান৷
পেছনে থাকা তার বন্ধু চিমটি কেটে বলল
-এই মুহিন, কী বলছিস।
ম্যাজিস্ট্রেট বিষয়টা লক্ষ্য করে মুহিন আর ওর বন্ধুকে পাঁচ মিনিটের জন্য দাঁড় করিয়ে রাখলো।
মুহিন আবারো গালি দিল৷ ইজহার মাহমুদ মুহিনের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলছিল
-ওরা পড়াশোনা করতে আসে না৷ ঝামেলা করতে আসে৷ আসুন,অন্য কক্ষে যায়৷
সেদিন মুহিনের খুব রাগ হয়েছিল৷ একটা মানুষ এত খারাপ হতে পারে তা ভাবতে ভাবতে রাত্রিতে তার ঠিক ঘুম হয়নি। অথচ এরা ই ভোটের সময় কত ভালো সাজে৷ সব কয়টা ভন্ড৷ সাধু সাজার ভং ধরে থাকে।
সকালে বাজার করতে মুহিনের মা ইয়ে বড় ফর্দ ধরিয়ে দিল। মফস্বল শহর, ফর্দের সব কিছু পেতে হলে যেতে হবে শহরের বাজারে।
মুহিন সাইকেল আর টাকা নিয়ে কানে হেডফোন গুজে ছুটলো বাজারের দিকে৷ কিছু দূর যেতে ই স্থানীয় স্কুলে ইজহার মাহমুদের আগমনের পোস্টার ছড়ানো।সে মনে মনে কয়েকবার গালি দিয়ে পোস্টারের দিকে তাকিয়ে সাইকেল চালিয়ে চাচ্ছিল।ঠিক সে সময় কোথা থেকে একটা প্রাইভেট কার শো করে এসে তার সামনে থামলো। মুহিন ভয়ে লাফ দিয়ে সাইকেল থেকে গড়িয়ে পড়ল৷ আর তার সাইকেল গাড়ির তলায় পড়ে দুমড়ে মুচড়ে গেলো৷ আশেপাশের অনেকে দৌড়ে এসে মুহিন কে টেনে তুলল। পেছনে পর পর দুটো গাড়ি এসে থামলো। প্রথমটা থেকে ইজহার মাহমুদ বের হতে ই যারা মুহিন কে টেনে তুলেছিল তারা ছুটে ইজহার মাহমুদের কাছে চলে গেল৷ ইজহার মাহমুদ রেগে মুহিনের কাছে এসে বলল
- দেখে চলতে পারো না৷ এখন আমি ব্রেক না ধরলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো৷ অশিক্ষিত, বেক্কলদের নিয়ে এক যন্ত্রনা৷ থাবড়ে সোজা করে দিতে হবে।
মুহিন চুপ করে থাকার ছেলে না। সে ও ভয় না পেয়ে বলে উঠলো
-আপনি দেখে চললে ই তো হতো৷ অযথা আমাকে গালি দিচ্ছেন কেন?
ইজহার মাহমুদ মুহিনের এমন বেয়াদবি দেখে আরো রেগে গেলো। উপস্থিত জনতার ভিড় দেখে কিছু না বলে মানি ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে মুহিনের দিকে দিয়ে বলল
-ডাক্তার দেখানোর জন্য যতেষ্ট হবে৷
মুহিন টাকাটা না নিয়ে ই পা খুড়িয়ে বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে দেখে ইজহার মাহমুদ রেগে অগ্নি শর্মা হয়ে মুহিনকে ডাকতে লাগলো।
-এই ছেলে,এ দিকে আসো বলছি।
মুহিন কারো কথা শুনলো না৷ হাত বাড়িয়ে একটা রিকশা থামিয়ে, রিকসায় উঠে চলে গেল। উপস্থিত জনতা বিস্ময়ে সেই দৃশ্য দেখলো, কিন্তু কেউ কিছু বলল না৷
এই এলাকায় ইজহার মাহমুদ এসেছিল স্কুলের নতুন ভবন উদ্ভোধনের সমাবেশে বক্তব্য দিতে। কিন্তু রাগে তার হাত পা কাঁপতে লাগলো৷ সেদিনের ছেলে তাকে এই ভাবে অপমান করতে পারে?সে এই সিটির মেয়র৷
ইজহার মাহমুদের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে৷ খাবার টেবিলে সে কোন কথা বলেনি। তার মা প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়েছে ঠিক ই। কিন্তু সে কিছুই মুখে তুলেনি৷ কিছুক্ষণ হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করে কিছু না বলে উঠে গেছে৷ কাল সকালে তার মিটিং আছে। যেতে হবে পৌরসভা কার্যালয়ে। আজকের সকালের ঘটনাটা তার মনে বিঁধে আছে। এত গুলো মানুষের সামনে সে এক প্রকার অপমানিত ই হয়েছে। বিরোধী পার্টি এটাকে ইস্যু করে নতুন কোন ঝামেলা পাকাতে পারে বলে মনে হচ্ছে তার। সে কিছুতেই রাগ নিয়ন্ত্রনে নিতে পারছে না৷ রুমে ঢুকে সে হাতের মোবাইলটা ছুড়ে মারলো বিছানায়৷
ইশা ভয়ে ভয়ে রুমে ঢুকলো।
ইশা এবার ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেছে। ইজহারের ইচ্ছে সে স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে পড়ুক কিন্তু ইশার ইচ্ছে সে ঢাকাতে পড়বে। সেটা নিয়ে দুই ভাই-বোনের মধ্যে মনোমালিন্য। ইশা বিছানার পাশে বসতে বসতে বলল
-ভাইয়া,তোমার কি মন খারাপ?
ইজহার অন্য দিকে তাকিয়ে বলল
-নাহ। কী বলবি বল
-আমি এখানে ই পড়ব৷
কথাটা শুনে ইজহার খুব খুশি হলো। তার রাগ নিমিষে পড়ে গেল।সে ইশার পাশে বসে আনন্দিত গলায় বলল
-সত্যি?
-সত্যি৷ তবে আমার একটা শর্ত আছে৷
-কী শর্ত?
-আগে বলো মানবে।
-হ্যা। মানব৷ বল তো আগে।
-শর্তটা হল, ভার্সিটিতে আমি একা যাব। সাথে তোমার ছেলেপুলে কেউ যাবে না। আমার উপর নজরদারি করা যাবে না৷ ফ্রীডম দিতে হবে আমাকে।
ইজহার মিনিট দুয়েক কী যেন ভাবোলো৷ তারপর বলল
-আচ্ছা৷ তাই হবে।
ইশা প্রফুল্ল মনে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
ইজহার জানে কখন তাকে কী করতে হবে৷ সময়ের আগে সেটা নিয়ে কথা বলা উচিত না বলে তার মনে হয়৷
মুহিন পা ভেঙ্গে বসে আছে।খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে৷ আজ তার ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কথা৷ সে একা যেতে পারছে না৷ তার আপু ফোন পেয়ে ছুটে এসেছে। সাথে তার দুলাভাই। মুহিনের দুলাভাই তার গাড়িতে করে মুহিন কে নিয়ে যাবে। ভার্সিটি থেকে মুহিনের আপুর স্বামীর বাড়ি অধিক দূরে না৷ তাই সেখানে তার একদিন থাকার কথা। মুহিন যাচ্ছে সেটা ঠিক কিন্তু একদিন থাকবে কিনা সেটা সে এখনো ভাবেনি।
তাদের গাড়ি থামলো সোজা ভার্সিটির সামনে। সেখানে অনেক লোকের ভিড় দেখে মুহিনের দুলাভাই তাকে গাড়িতে বসে থাকতে বলে কাগজপত্র নিয়ে চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পরে পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে সমানে হর্ণ দিয়ে যাচ্ছে।মুহিন কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিল। গাড়ির জানালায় ধুমধাম শব্দ শুনে কান থেকে হেডফোন সরিয়ে জানালা খোলতেই দেখে ইজহার মাহমুদ দাঁড়িয়ে। মুহিন ইজহার মাহমুদকে দেখে মনে মনে বার কয়েক আল্লাকে ডেকে নিল। এই লোক মানে ই ঝামেলা।
-এই হারামজাদা,এটা পার্কিং জায়গা?অন্ধ নাকি তুই?গাড়ি সরা।
মুহিন ভয়ে ভয়ে জবাব দিল
-গাড়ি আমার না। আমি কী করে সরাব?
-গাড়ি তুর না হলে গাড়িতে বসে আছিস কোন আক্কেলে?
-শুনুন,শান্ত হোন। অপেক্ষা করুন একটু। দুলাভাই আসলে ওনি সরিয়ে দিবেন।
ইজহার মুহিনের কোন কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে মুহিন কে টেনে বের করে আনলো। মুহিন ভয়ে কাঁপছিল। সে তার ভাঙ্গা পা নিয়ে গাড়িতে হাত দিয়ে দাঁড়াতে যাব ঠিক তখন দু তিনটে ছেলে এসে গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা মারলো। মুহিন মাটিতে পড়ে গেল৷ তার ভাঙ্গা পায়ে সে আবার ব্যথা পেয়েছে। যন্ত্রনায় মাগো বলে কেঁদে উঠলো।
ইজহার মাহমুদ মুহিনের দিকে তাকালো। তার চোখে পানি, সে ব্যথায় কাঁদছে কিন্তু কিছু বলছে না। ইজহার মাহমুদের কী যেন হলো, হুট করেয় মুহিনের প্রতি মায়াতে সে যেন কেমন হয়ে গেল৷ সে এগিয়ে গেল মুহিনের কাছে। তার রাগি,কর্কশ চেহারাটা মুহুর্তে কোমল হয়ে গেল৷ সে মুহিন কে বলল
-ব্যথা পেয়েছ?
মুহিন উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল
-যান এখন এখান থেকে। আপনারা তো ক্ষমতার জোরে মানুষকে মানুষ মনে করেন না। ভাবেন, আপনাদের ক্ষমতা আছে৷ আপনারা ই মানুষ৷ বাকিরা জীব জন্তু।
ইজহার মাহমুদ তখনো চুপ। মুহিন নিজে নিজে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক সেই সময় মুহিনের আপা আর দুলাভাই আসলো। তাদের আসতে দেখে ইজহার চলে যায়।
সুবর্ণা,কেঁদে কেঁটে অস্থির৷ তার ভাইয়ে পায়ের ব্যথায় সারা রাত্রি ঘুমাতে পারেনি। পা ফোলে আছে। ডক্টর বলেছে টানা রেস্ট নিতে হবে৷ এদিকে মুহিন বাড়ি যেতে বায়না ধরেছে। কিন্তু মুহিনের বাবা চাচ্ছে সে ভার্সিটিতে এখান থেকে ই পড়ুক৷ মুহিনের দুলাভাই ও অবশ্য এটাই চাচ্ছে। তার বাড়িতে তার বৃদ্ধ বাবা মা ছাড়া আর কেউ নেই৷ ওনারা ও মুহিন কে যতেষ্ট যত্ন করেন৷ কিন্তু মুহিন তার নদী,বন্ধু বান্ধব আর মাকে ছাড়া থাকতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা বাচ্চা ছেলে৷ সুবর্ণা সারা রাত্রি মুহিন কে বুঝিয়েছে। মুহিন স্থির করতে পারছে না সে কী করবে।
এদিকে ইজহার বাসায় ফিরে গোসল করে নিজের বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে সকালের কথাটা ভাবছিল। সে এতটা রাগ না দেখালে ও পারত। ছোট একটা ছেলে৷ ওর সাথে এত কঠিন ব্যবহার করা উচিত হয়নি৷ আর যায় হোক সে সিটির মেয়র। তাকে আরো কোমল হওয়া উচিত।
রাতে ইজহার স্বপ্ন দেখলো ঐ ছেলেটা আর সে একি গাড়িতে কোথায় যেন যাচ্ছে৷ ছেলেটা ইজহারের হাত ধরে আছে৷ ইজহার লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসছে৷
এমন উদ্ভট স্বপ্নে দেখে ইজহারের মাথা বিগড়ে গেলো। এ কেমন স্বপ্ন৷ চেনা নেই,জানা নেই অযাচিত এক ছেলেকে তার সাথে এত ঘনিষ্ঠ হতে স্বপ্নে দেখার কী মানে।ভেতরে তার কেমন যেন করছিল কিন্তু ইজহার মানতে নারাজ।
সে ঘুম থেকে জেগে ফ্রেশ হয়ে মিটিং রুমে চলে গেল৷ সে ভেবেছিল,মিটিং রুমের ব্যস্ততায় তার স্বপ্নের কথাটা কিছুই মনে থাকবে না কিন্তু মন এত কিছু কি আর বুঝে৷ বারবার একি স্বপ্ন মনে পড়ছিল৷ সেই শান্ত ছেলেটি,তার স্নিগ্ধ এক জোড়া চোখ,মায়াময় হাসি আর কামুক শরীর।
.......(চলবে)
চলবে না দৌড়বে! আমার সত্যি বলতে অনেক ইচ্ছা এই আরভান শান আরাফ নামের মানুষটার আসল পরিচয় জানার এবং তার সাথে দেখা দেখা করার! যদি উনি কমেন্ট টা পড়েন তাহলে প্লিজ শুনুন আমি আপনার অনেক বড় একজন ভক্ত!
ReplyDeleteশুনে ভালো লাগলো। আশা করি এভাবে ই পাশে পাব৷ সর্বদা
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ যে আপনি রিপ্লাই করেছেন! হ্যা অবশ্যই আপনার পাশে থাকবো!
Delete