শূণ্যস্থান-৩
আরভান শান আরাফ
গোসাইপুর গ্রামের মানুষগুলো বড্ড সহজ সরল। পূর্বে আরো বেশি ছিল৷ অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় আচ্ছন্ন মানুষগুলোর জন্য নিবিড় দিন রাত খেটেছে। তাদের ভাগ্যের আজ যে উন্নতি তা নিবিড়ের জন্যই। এখন নিবিড়ের যাওয়ার সময় হয়েছে।হুট করে এই গ্রামে জাবেরের বাসায় সুমনের আগমন নিবিড়কে প্রায় নাড়িয়ে দিয়েছে৷ যাদের নিয়ে তার মিছে মিছে বেঁচে থাকা তাদের ছেড়ে যাওয়াটা সহজ নয় তার জন্য৷
নিবিড়ের মনে প্রশ্ন জাগে, সুমন কি এখানে অনেকদিন থাকবে? নাকি চলে যাবে? চলতে চলতে যদি পথে দেখা হয়ে যায়৷ ঐ খারাপ লোকটাকে কী বলবে সে? যে তার সাথে ভালবাসার মিছে অভিনয় করে গেছে এতটা কাল?তার চোখে চোখ তুলে তাকাতে পারবে সে? ভুলে যাওয়া সময়গুলো ভেবে তার চোখ দিয়ে জল পড়বে না তো? নিবিড় কি পারবে পাথরের মত হৃদয় নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে?
এই অঞ্চলে সুমন এসেছে গতকাল রাতে। এখন সকাল নয়টা৷ সুমন, জাবের,অহনা,মিতু খাবারের টেবিলে। অনেক দিন পর তারা সবাই খুশি৷ সুমনের মন বিক্ষিপ্ত। জাবের মিতুকে শুধু এতটুকু বলেছে, সে নিবিড়ের খবর দিবে। তা শুনেই মিতু নিবিড়কে নিয়ে চলে এসেছে।মিতু এখন মনে প্রাণে চায়, নিবিড় ফিরে আসুক। ভালবাসার মানুষটাকে দিনের পর দিন এমন কষ্টে দেখতে সে ও চাচ্ছে না। নিবিড় ফিরে আসুক প্রশান্তি হয়ে তাদের জীবনে সেটা অহনার ও প্রত্যাশা৷ কিন্তু যা গত হয়েছে, বদলে গেছে অথবা চলে গেছে তা ফিরে আসাটা যে ততটা সহজ নয় সেটা এই চারজনের মধ্যে কেবল অহনা ই জানে।
জাবের একটা কলায় কামড় দিয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
-ভাইয়া কি একদম ই হাসেন না?
সুমন কিছু বলল না, বলল মিতু
-ও হাসে। স্বপ্নে।
মিতু সত্য ই বলেছে।সুমন স্বপ্নে ই বেশি হাসে৷ সে যখন নিনিড়কে স্বপ্নে দেখে, সে যখন স্বপ্নে নিবিড়ের হাতে হাত রেখে পথ চলে তখন ই কেবল সে হাসে৷ বাকি সময়, বাস্তবে সে হাসে না। ভেতরটা থেকে কোন প্রকার হাসি আসে না। কেমন জলন্ত আগুনের ধোয়া বের হয়।
নিবিড় ঘর ছেড়ে বের হতেই সামনে জাবের। তার হাতে কালো ব্যাগ । গলায় স্ট্যাথোস্কোপ আর পড়েনে নীল রঙের পাঞ্জাবী৷ তার মুখ হাস্যজ্জোল।নিবিড়কে দেখতে পেয়েই সে চোখ মুখে রঙিন আনন্দের আভা এনে কাছে এসে বলল
-কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
নিবিড়, ভেবেছিল উত্তর দিবে না৷ কিন্তু সে দিল। মুখে অভিনয়ে একটা কোমল হাসি এনে বলল
-রাধানগর যাব একটু।
-বিশেষ কাজে?
-তেমন কাজে নয়। ঐখানকার এক ভদ্রলোকে খবর পাঠিয়েছে।
-আচ্ছা,যান৷ তবে সন্ধ্যার দিকে অবসর তো নাকি?
-সন্ধ্যা হোক।
বলেই নিবিড় হনহন করে হেঁটে চলে গেল। কথার পিঠে কথা বলে আত্মীয়তা বাড়াতে সে আগ্রহী নয়৷ সে এড়িয়ে যেতে চায়৷
জাবের অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল বিস্মিত এই ছেলেটাকে। কত বিস্ময় তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ সবাইকে মুগ্ধ করার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে সে। আর সেই জন্য এতগুলা মানুষ তার অনুপস্থিতির কষ্ট পাচ্ছে।
নিবিড় বসে আছে দু তলা বাড়িটার সামনে। রাধানগর সহ আশেপাশের একাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি মইন চৌধুরি। তার বাবার মৃত্যুর পরে সে তার প্রভাব আরো বেশি বিস্তার করেছে। নিবিড় এসেছে একটা অভিযোগ নিয়ে। মেঘনায় যে ইঞ্জিন চালিত নৌকা আছে তার সব কয়টা ইদানিং বাধা হচ্ছে গোসাইপুর এলাকার ধানী জমির পাশে। যার ফলে নৌকার তেলে সেখানকার পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এতে দশবারোজন চাষীর সদ্য লাগানো চারা নষ্ট হয়ে গেছে। নিবিড় চাইলে থানায় যেতে পারত। কিন্তু গ্রাম প্রধানের কথায় তার এখানেই আসতে হয়েছে।
নিবিড় আধা ঘন্টা ধরে বসে। পুকুর পাড়ে সুন্দর বেঞ্জি পেতে বসার আয়োজন৷ চা দিয়ে গেছে। তাতে দুধের সর ভাসছে৷ নিবিড় চায়ে মুখ না দিয়ে পুকুরের রাজহংসিগুলো দেখছিল। এই সময় দু তিনজন লোক সহ মইন চৌধুরি এসে গলা ঝাড়ি দিয়ে মুখ বরাবর বসল। মইন ফিরে তাকাতেই, মইন চৌধুরি মুগ্ধ হলেন। তিনি মনে মনে ভেবে নিলেন
-এই তাহলে গোসাইপুরের যুবা মাস্টার। নাম-পরিচয়হীন একটা ছেলে যে গ্রামের রূপ ই পালটে দিয়েছে।
মইন চৌধুরির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাঠি হাতের জনৈক ভদ্রলোক ভারি গলায় বলল
-কী বলবেন, বলুন৷ জনাবের যায়তে হবে।
নিবিড় তার অভিযোগ জানাল। মইন মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বলল
-কাল আমি নিজে গিয়ে দেখে আসব।
নিবিড় সম্মানে চোখ নুইয়ে বলল।
-আপনাকে ধন্যবাদ। বলে উঠতে যাবে ঠিক সেই সময় মইন বলল।
-খানিক বসুন৷ পরিচিত হয়।
নিবিড় না বসেই বলল।
-আমি পরিচিত হওয়ার মত কেউ নয়।
মইন তাকিয়ে রইল।
নিবিড় হেঁটে যাচ্ছে। মইন সে দিকে তাকিয়ে৷ তার সারাক্ষণ মনে হতে লাগল, ছেলেটাকে সে চিনে। দেখেছে৷ পূর্বে, বহূবার৷ হয়ত জাগরণে অথবা ঘুমে।
মইন চৌধুরির বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে হয়ত। শক্ত সবল লোক। মাথায় ঘন কালো চুল। গাঁয়ের রঙ শ্যামলা। বড় বড় চোখ৷ পেশি বহুল শরীর।মুখে এক দু ইঞ্জি লম্বা ঘন দাঁড়ি৷চওড়া বুক আর ভারী কন্ঠস্বর।যত দিন তার বাবা ছিল ততদিন বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল৷ এখন বাবা নেই, মা, আর দু বোন আছে। তারা ও কম পীড়াপীড়ি করে না৷ কিন্তু, এই ঝামেলা সেই ঝামেলা বলে আর বিয়ে করা হচ্ছে না। সময় চলে যাচ্ছে, আর মইন চৌধুরির একাকিত্বের সময়টা ও দীর্ঘতর হচ্ছে৷
এখন বিকেল৷ সুমন,মেঘনায় সূর্য ডোবে যাওয়া দেখছে। এই দিকটা নিরব৷লোকজনের তেমন যাতায়াত ও নেই।বিকেলের দিকে কইতরি যুবা মাস্টারের কাছে যাবে বলে বাড়ি থেকে বের হতেই দূরে কাউকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এল৷
-এই যে, আপনি কে?
সুমন ফিরে তাকাল। তার চিকন চশমার ঐপাশে যে মেয়েটা তার বয়স চৌদ্দ পনেরো হবে হয়ত।দারুন মিষ্টি মেয়েটা দেখতে।গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা সাধারণত এমন হয় না৷ সুমন মুচকি হেসে বলল
-তুমি আমাকে চিনবে না মেয়ে।
-নাম কইলেন তো চিনি।
-আমার নাম সুমন। চিনলে?
-জে না৷ চিনি নাই৷
-হা হা হা হা
কইতরীর বিস্ময়ের সীমা রইল না। এই লোকটা একদম যুবা মাস্টারের মত হাসে। কইতুরির খানিক সময়ের জন্য ভ্রম হল। মনে হল এই লোকটার দেহের যে প্রতিবিম্ব পড়েছে জলে তা যেন যুবা মাস্টার নিজেই। লোকটার চোখে মুখে অদ্ভুত বেদনা। কইতরি বিস্ময়ে প্রশ্ন করল
-আফনি কি যুবা মাস্টারের কিছু লাগেন?
-যুবা মাস্টার! কে সে?
-আফনি চিনবেন না। বলেই চলে গেল সে।
সুমন তাকিয়ে রইল। খানিকের জন্য তার ও মনে হচ্ছিল যে, মেয়েটা নিবিড়ের কথা বলছিল না তো? তার বুক ভারী হয়ে এল।চোখ বন্ধ করে সে কয়েকবার নিবিড়ের নাম নিল।তার চোখে মুখে ভেসে উঠল সেই আঠার উনিশ বয়সের নিবিড়ের চেহারাটা। তার সদ্য গজিয়ে উঠা দাড়ি সুমন যখন জিহবার লালায় চুমু খেয়ে ভিজিয়ে দিত তখন নিবিড় সুমনের নাকে কামড় দিয়ে বলত
-তুমি কি আমাকে বড় হতে ও দিবে না?
-না। তুমি সব সময় ছোট ই থাকবা। যেন আমার বুকের পাশে মিশে থাকতে পারো।
নিবিড় হাসত। নিবিড়ের হাসি সুমনকে আরো বেশি প্রেমিক করে তুলত৷ সেই দিন,সেই ভালবাসা,সেই হাসি আর মানুষটা হারিয়ে গেছে। সাথে হারিয়ে গেছে সুমনের সুখ।
সূর্য ডুবার পরে নিবিড় ঘরে ফিরে এল৷এলাকায় বিদ্যুৎ নেই।চারদিক অন্ধকার। কিছু দিন ধরে লোডশেডিং একটু বেশি ই হচ্ছে। নিবিড় ফেরার পথে হাতে করে একটা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেটা এখন জ্বলে প্রায় শেষ। ঘরের পাশে আসতেই তার ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠল। তারমনে হল ওখানে,তার ঘরের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে৷ নিবিড় গলা ঝাড়ি দিল। কোন শব্দ হল না। ছায়ামূর্তিটা তার দিকে এগিয়ে এল।কাছে আসতেই চেহারা স্পষ্ট হল। এটা মইন চৌধুরি। অথচ তিনি তো লোক ছাড়া একা বের হন না। নিবিড় ঘাবড়ে গিয়েছিল তাকে দেখে, গলা শুকিয়ে এসেছিল। নিজেকে সামলে সে প্রশ্ন করল
-আ আ আপনি?
মইন চৌধুরি আরেকটু এগিয়ে এসে আনন্দ চিত্তে উত্তর দিল
-হ্যা৷ আমি।
-কিন্তু, রাতে? আপনার লোকজন?
-হুম৷ এলোম। লোকজন নৌকায়। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ মনে হল একবার দেখে যায় আপনাকে।
-আসুন না ঘরে আসুন।
-না৷ দেখা হয়ে গেছে। চলে যাব।
মইন চৌধুরি চলে যেতে পা বাড়াতে না বাড়াতে নিবিড় প্রশ্ন করল
-জমিগুলো দেখতে কবে আসবেন?
-যে কোন সময়।
মইন চৌধুরি হনহন করে হেঁটে চলে গেল। নিবিড় বিস্মিত হল। এই বিত্তবান লোকটিকে তার কাছে অকারণেই অদ্ভুত মনে হল।
নিবিড় নিজের ঘরে ঢুকে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে নিজেকে দেখছিল৷ মশালের আলোয় তার বুকের পশমগুলো চিকচিক করছিল। অনেকগুলো বছর আগে যখন এই পশমগুলো গজাতে শুরু করেছিল তখন সুমন তার বুকে চুমু খেয়ে বলত,
-বুকে পশম রাখবে না।
নিবিড় প্রশ্ন করত
-কেন?
উত্তরে সে বলেছিল
-চুমু খাওয়ার সময় মুখে ঢুকে যাবে।
নিবিড় ধাক্কা দিয়ে সুমনকে চিৎ করে শুয়ে দিয়ে তার বুকে চড়ে তার বুক পশমে দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে বলত
-তাহলে, মিঃ এইগুলো? ফেলে দেই?
তারা হাসত৷ তাদের হাসিতে ইশ্বরের হিংসে হত। তাই তাদের ভাগ্য মুছে, পরস্পরকে আলাদা করে নতুন করে যে ভাগ্য লিখল তাতে কেউ ই কারো না।
রাতে মইনের ঘুম হয়নি। সকাল সাতটার দিকে জেগে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল। তার ভেতরটাই কেমন জানি উদাসীনতা।মনে হল এই একাকিত্বের, নিসঙ্গতার পরিবর্তন হওয়া দরকার।ইচ্ছে ছিল গোসাইপুর যাওয়ার কিন্তু কী মনে করে যেন গেলো না। হয়তো কারো প্রতি আসক্ত হওয়ার ভয়ে অথবা ভিন্ন কোন কারনে।
নিবিড় ক্লাস নিচ্ছিল। দপ্তরি কাকা এসে বলল তাকে কেউ ডাকছে৷ নিবিড় ক্লাস থেকে বের হয়ে এল।অফিস রুমে ঢুকার আগ পর্যন্ত তার মনে হয়নি যে, তার জন্য জীবনের আরো একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। নীল রঙের শাড়ী পড়ে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে জৈনিক ভদ্র মহিলাকে দেখে সে ভেবেছিল, হবে হয়ত কোন শিক্ষার্থীর অভিবাবক। নিবিড় চেয়ারে বসতে বসতে বলল
-আসুন, বসুন।
ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল
-কেমন আছেন?
-ভাল। কিন্তু আপনি?
-আমাকে চেনার কথা না।
-কেন?
-সেসব থাক।সকালে খেয়েছিলেন?
-জি। কী খাবেন বলুন৷
-কী খাওয়াতে পারবেন?
-গ্রাম্য এলাকা। সাধ্যের মধ্যে যা আছে। তবে পরিচয়টা জানা থাকলে সুবিধে হত।
-আমি মিতু। একটা কলেজে রসায়ন পড়াচ্ছি।আপনাকে দেখার অভিপ্রায় থেকে এখানে আসা।
-হঠাৎ,আমার মত গুণহীন কারো ব্যপারে আগ্রহের কারন টা ঠিক বোধগম্য হল না।
-কারন তো অনেকগুলা ই আছে। তবে সেই কারনগুলা তুলা থাক। আমি আজ উঠি।
-সে কি? আসার হেতু না বলেই উঠবেন।
-হ্যা,উঠব। আবার দেখা হচ্ছে৷ খুব দ্রুত৷
মিতু উঠে বাহিরের দিকে বের হয়ে গেল। নিবিড় তাকিয়ে রইল৷ এই অদ্ভুত মহিলাটিকে তার কাছে বিস্ময় মনে হচ্ছিল।
ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে মেঘনা ফুসে উঠল। প্রবল বাতাস শুরু হল। বোর্ড অফিস হতে ঐ পাড়ে আসতে না আসতেই শুরু হল বর্ষণ। সাথে সাথে বাতাস। ভয়ানক ঝড়ে নৌকা প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম। চড়ে আসার পর বর্ষণ আরো প্রবলতর হল। সাথে বাতাসের ঝাপ্টা। গাছগুলো মড়মড় করে ভাঙতে লাগল। নিবিড় নৌকা থেকে নেমে নৌকাটা খুটিতে বেধে দ্রোত হাটতে লাগল। বিপরীত মুখি বাতাসের ধাক্কায় সামনের দিকে আগানোর সুযোগ নেই।তারুপরে চড়ের উড়ন্ত বালি। নিবিড়ে পড়নের পাঞ্জাবীটা খোলে মাথায় বেধে ফেলল। আর পকেট থেকে রুমালটা খোলে চোখ মুখ চেপে ধরল। কবরস্থানের দিক দিয়ে যাওয়ার সময় যখন গাছের ডাল এসে উড়ে মাথায় পড়ার উপক্রম ঠিক সেই সময় পিছন থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ডালটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে আকাশে বিজলি চমকালো। সেই আলোতে নিবিড় এমন একজনের চেহারা দেখল যাকে সে ভুলার জন্য এতটা সংগ্রাম করে আসছে।নিবিড় উঠে দাঁড়াল শক্ত হয়ে। সুমনের কন্ঠস্বর ভেসে আসল।
-ব্যথা পাননি তো?
নিবিড় উত্তর না দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।সুমন এগিয়ে এল। সুমন যখন নিবিড়ের ঠিক পাশে তখন আবার বিদ্যুৎ চমকালো। সেই বিদ্যুতের আলো সুমনের জীবন আলোকিত করার পথ দেখাল। আজ এত দিন পর যে মানুষটাকে একটিবার দেখার জন্য ছটফট করেছিল সে তার সামনে দাঁড়িয়ে।সুমন বাকরুদ্ধ। নিবিড়ের চোখে চোখ পড়তেই আনন্দে তার হৃদয়ে বিদ্যুৎ চমকাল। সে নিবিড়ের হাতটা টেনে ধরে বলল
-নি নি নিবিড়৷ আমি তোমায় অনেক খোঁজেছি। নিবিড়।
নিবিড় শব্দ করেনি। যে হাতটা সুমন তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করে দৌড়ে চলে গেল। সুমন এই ঝড় বৃষ্টির রাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। এত দিনের কষ্ট আজ তার লাগব হল।
সে ভিজে বাসায় গেল। অহনা আর মিতু গভীর চিন্তায় ছিল৷ তাকে দেখে চিন্তামুক্ত হল। আজ অনেক দিন পর সুমনের ঠোটের কোণায় হাসি দেখে মিতু প্রশান্তির নিশ্বাস নিল। মানুষটাকে হাসলে সত্য ই সুন্দর লাগে।
নিবিড় রুমে এসে কাঁপতে লাগল। ঝড় থেমে গেছে।কিন্তু নিবিড়ের বুকে যে ঝড় উঠেছে তা থামার নাম নেই। নিবিড়ে বাহিরে এসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নিরব এই চরে তার কান্না, যন্ত্রনা শুনার মত কেউ নেই৷ সে অসহায়৷ একা৷ সে নির্জন। নিরব।ইশ্বর কী চায়, কী তার খেলার ফলাফল তা কেবল ইশ্বর ই জানে।
..............চলবে.............
আরভান শান আরাফ
গোসাইপুর গ্রামের মানুষগুলো বড্ড সহজ সরল। পূর্বে আরো বেশি ছিল৷ অশিক্ষা আর কুশিক্ষায় আচ্ছন্ন মানুষগুলোর জন্য নিবিড় দিন রাত খেটেছে। তাদের ভাগ্যের আজ যে উন্নতি তা নিবিড়ের জন্যই। এখন নিবিড়ের যাওয়ার সময় হয়েছে।হুট করে এই গ্রামে জাবেরের বাসায় সুমনের আগমন নিবিড়কে প্রায় নাড়িয়ে দিয়েছে৷ যাদের নিয়ে তার মিছে মিছে বেঁচে থাকা তাদের ছেড়ে যাওয়াটা সহজ নয় তার জন্য৷
নিবিড়ের মনে প্রশ্ন জাগে, সুমন কি এখানে অনেকদিন থাকবে? নাকি চলে যাবে? চলতে চলতে যদি পথে দেখা হয়ে যায়৷ ঐ খারাপ লোকটাকে কী বলবে সে? যে তার সাথে ভালবাসার মিছে অভিনয় করে গেছে এতটা কাল?তার চোখে চোখ তুলে তাকাতে পারবে সে? ভুলে যাওয়া সময়গুলো ভেবে তার চোখ দিয়ে জল পড়বে না তো? নিবিড় কি পারবে পাথরের মত হৃদয় নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে?
এই অঞ্চলে সুমন এসেছে গতকাল রাতে। এখন সকাল নয়টা৷ সুমন, জাবের,অহনা,মিতু খাবারের টেবিলে। অনেক দিন পর তারা সবাই খুশি৷ সুমনের মন বিক্ষিপ্ত। জাবের মিতুকে শুধু এতটুকু বলেছে, সে নিবিড়ের খবর দিবে। তা শুনেই মিতু নিবিড়কে নিয়ে চলে এসেছে।মিতু এখন মনে প্রাণে চায়, নিবিড় ফিরে আসুক। ভালবাসার মানুষটাকে দিনের পর দিন এমন কষ্টে দেখতে সে ও চাচ্ছে না। নিবিড় ফিরে আসুক প্রশান্তি হয়ে তাদের জীবনে সেটা অহনার ও প্রত্যাশা৷ কিন্তু যা গত হয়েছে, বদলে গেছে অথবা চলে গেছে তা ফিরে আসাটা যে ততটা সহজ নয় সেটা এই চারজনের মধ্যে কেবল অহনা ই জানে।
জাবের একটা কলায় কামড় দিয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
-ভাইয়া কি একদম ই হাসেন না?
সুমন কিছু বলল না, বলল মিতু
-ও হাসে। স্বপ্নে।
মিতু সত্য ই বলেছে।সুমন স্বপ্নে ই বেশি হাসে৷ সে যখন নিনিড়কে স্বপ্নে দেখে, সে যখন স্বপ্নে নিবিড়ের হাতে হাত রেখে পথ চলে তখন ই কেবল সে হাসে৷ বাকি সময়, বাস্তবে সে হাসে না। ভেতরটা থেকে কোন প্রকার হাসি আসে না। কেমন জলন্ত আগুনের ধোয়া বের হয়।
নিবিড় ঘর ছেড়ে বের হতেই সামনে জাবের। তার হাতে কালো ব্যাগ । গলায় স্ট্যাথোস্কোপ আর পড়েনে নীল রঙের পাঞ্জাবী৷ তার মুখ হাস্যজ্জোল।নিবিড়কে দেখতে পেয়েই সে চোখ মুখে রঙিন আনন্দের আভা এনে কাছে এসে বলল
-কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
নিবিড়, ভেবেছিল উত্তর দিবে না৷ কিন্তু সে দিল। মুখে অভিনয়ে একটা কোমল হাসি এনে বলল
-রাধানগর যাব একটু।
-বিশেষ কাজে?
-তেমন কাজে নয়। ঐখানকার এক ভদ্রলোকে খবর পাঠিয়েছে।
-আচ্ছা,যান৷ তবে সন্ধ্যার দিকে অবসর তো নাকি?
-সন্ধ্যা হোক।
বলেই নিবিড় হনহন করে হেঁটে চলে গেল। কথার পিঠে কথা বলে আত্মীয়তা বাড়াতে সে আগ্রহী নয়৷ সে এড়িয়ে যেতে চায়৷
জাবের অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল বিস্মিত এই ছেলেটাকে। কত বিস্ময় তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ সবাইকে মুগ্ধ করার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে সে। আর সেই জন্য এতগুলা মানুষ তার অনুপস্থিতির কষ্ট পাচ্ছে।
নিবিড় বসে আছে দু তলা বাড়িটার সামনে। রাধানগর সহ আশেপাশের একাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি মইন চৌধুরি। তার বাবার মৃত্যুর পরে সে তার প্রভাব আরো বেশি বিস্তার করেছে। নিবিড় এসেছে একটা অভিযোগ নিয়ে। মেঘনায় যে ইঞ্জিন চালিত নৌকা আছে তার সব কয়টা ইদানিং বাধা হচ্ছে গোসাইপুর এলাকার ধানী জমির পাশে। যার ফলে নৌকার তেলে সেখানকার পানি দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এতে দশবারোজন চাষীর সদ্য লাগানো চারা নষ্ট হয়ে গেছে। নিবিড় চাইলে থানায় যেতে পারত। কিন্তু গ্রাম প্রধানের কথায় তার এখানেই আসতে হয়েছে।
নিবিড় আধা ঘন্টা ধরে বসে। পুকুর পাড়ে সুন্দর বেঞ্জি পেতে বসার আয়োজন৷ চা দিয়ে গেছে। তাতে দুধের সর ভাসছে৷ নিবিড় চায়ে মুখ না দিয়ে পুকুরের রাজহংসিগুলো দেখছিল। এই সময় দু তিনজন লোক সহ মইন চৌধুরি এসে গলা ঝাড়ি দিয়ে মুখ বরাবর বসল। মইন ফিরে তাকাতেই, মইন চৌধুরি মুগ্ধ হলেন। তিনি মনে মনে ভেবে নিলেন
-এই তাহলে গোসাইপুরের যুবা মাস্টার। নাম-পরিচয়হীন একটা ছেলে যে গ্রামের রূপ ই পালটে দিয়েছে।
মইন চৌধুরির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাঠি হাতের জনৈক ভদ্রলোক ভারি গলায় বলল
-কী বলবেন, বলুন৷ জনাবের যায়তে হবে।
নিবিড় তার অভিযোগ জানাল। মইন মনোযোগ দিয়ে শোনার পর বলল
-কাল আমি নিজে গিয়ে দেখে আসব।
নিবিড় সম্মানে চোখ নুইয়ে বলল।
-আপনাকে ধন্যবাদ। বলে উঠতে যাবে ঠিক সেই সময় মইন বলল।
-খানিক বসুন৷ পরিচিত হয়।
নিবিড় না বসেই বলল।
-আমি পরিচিত হওয়ার মত কেউ নয়।
মইন তাকিয়ে রইল।
নিবিড় হেঁটে যাচ্ছে। মইন সে দিকে তাকিয়ে৷ তার সারাক্ষণ মনে হতে লাগল, ছেলেটাকে সে চিনে। দেখেছে৷ পূর্বে, বহূবার৷ হয়ত জাগরণে অথবা ঘুমে।
মইন চৌধুরির বয়স ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে হয়ত। শক্ত সবল লোক। মাথায় ঘন কালো চুল। গাঁয়ের রঙ শ্যামলা। বড় বড় চোখ৷ পেশি বহুল শরীর।মুখে এক দু ইঞ্জি লম্বা ঘন দাঁড়ি৷চওড়া বুক আর ভারী কন্ঠস্বর।যত দিন তার বাবা ছিল ততদিন বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল৷ এখন বাবা নেই, মা, আর দু বোন আছে। তারা ও কম পীড়াপীড়ি করে না৷ কিন্তু, এই ঝামেলা সেই ঝামেলা বলে আর বিয়ে করা হচ্ছে না। সময় চলে যাচ্ছে, আর মইন চৌধুরির একাকিত্বের সময়টা ও দীর্ঘতর হচ্ছে৷
এখন বিকেল৷ সুমন,মেঘনায় সূর্য ডোবে যাওয়া দেখছে। এই দিকটা নিরব৷লোকজনের তেমন যাতায়াত ও নেই।বিকেলের দিকে কইতরি যুবা মাস্টারের কাছে যাবে বলে বাড়ি থেকে বের হতেই দূরে কাউকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এল৷
-এই যে, আপনি কে?
সুমন ফিরে তাকাল। তার চিকন চশমার ঐপাশে যে মেয়েটা তার বয়স চৌদ্দ পনেরো হবে হয়ত।দারুন মিষ্টি মেয়েটা দেখতে।গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা সাধারণত এমন হয় না৷ সুমন মুচকি হেসে বলল
-তুমি আমাকে চিনবে না মেয়ে।
-নাম কইলেন তো চিনি।
-আমার নাম সুমন। চিনলে?
-জে না৷ চিনি নাই৷
-হা হা হা হা
কইতরীর বিস্ময়ের সীমা রইল না। এই লোকটা একদম যুবা মাস্টারের মত হাসে। কইতুরির খানিক সময়ের জন্য ভ্রম হল। মনে হল এই লোকটার দেহের যে প্রতিবিম্ব পড়েছে জলে তা যেন যুবা মাস্টার নিজেই। লোকটার চোখে মুখে অদ্ভুত বেদনা। কইতরি বিস্ময়ে প্রশ্ন করল
-আফনি কি যুবা মাস্টারের কিছু লাগেন?
-যুবা মাস্টার! কে সে?
-আফনি চিনবেন না। বলেই চলে গেল সে।
সুমন তাকিয়ে রইল। খানিকের জন্য তার ও মনে হচ্ছিল যে, মেয়েটা নিবিড়ের কথা বলছিল না তো? তার বুক ভারী হয়ে এল।চোখ বন্ধ করে সে কয়েকবার নিবিড়ের নাম নিল।তার চোখে মুখে ভেসে উঠল সেই আঠার উনিশ বয়সের নিবিড়ের চেহারাটা। তার সদ্য গজিয়ে উঠা দাড়ি সুমন যখন জিহবার লালায় চুমু খেয়ে ভিজিয়ে দিত তখন নিবিড় সুমনের নাকে কামড় দিয়ে বলত
-তুমি কি আমাকে বড় হতে ও দিবে না?
-না। তুমি সব সময় ছোট ই থাকবা। যেন আমার বুকের পাশে মিশে থাকতে পারো।
নিবিড় হাসত। নিবিড়ের হাসি সুমনকে আরো বেশি প্রেমিক করে তুলত৷ সেই দিন,সেই ভালবাসা,সেই হাসি আর মানুষটা হারিয়ে গেছে। সাথে হারিয়ে গেছে সুমনের সুখ।
সূর্য ডুবার পরে নিবিড় ঘরে ফিরে এল৷এলাকায় বিদ্যুৎ নেই।চারদিক অন্ধকার। কিছু দিন ধরে লোডশেডিং একটু বেশি ই হচ্ছে। নিবিড় ফেরার পথে হাতে করে একটা মশাল জ্বালিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেটা এখন জ্বলে প্রায় শেষ। ঘরের পাশে আসতেই তার ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠল। তারমনে হল ওখানে,তার ঘরের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে৷ নিবিড় গলা ঝাড়ি দিল। কোন শব্দ হল না। ছায়ামূর্তিটা তার দিকে এগিয়ে এল।কাছে আসতেই চেহারা স্পষ্ট হল। এটা মইন চৌধুরি। অথচ তিনি তো লোক ছাড়া একা বের হন না। নিবিড় ঘাবড়ে গিয়েছিল তাকে দেখে, গলা শুকিয়ে এসেছিল। নিজেকে সামলে সে প্রশ্ন করল
-আ আ আপনি?
মইন চৌধুরি আরেকটু এগিয়ে এসে আনন্দ চিত্তে উত্তর দিল
-হ্যা৷ আমি।
-কিন্তু, রাতে? আপনার লোকজন?
-হুম৷ এলোম। লোকজন নৌকায়। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।হঠাৎ মনে হল একবার দেখে যায় আপনাকে।
-আসুন না ঘরে আসুন।
-না৷ দেখা হয়ে গেছে। চলে যাব।
মইন চৌধুরি চলে যেতে পা বাড়াতে না বাড়াতে নিবিড় প্রশ্ন করল
-জমিগুলো দেখতে কবে আসবেন?
-যে কোন সময়।
মইন চৌধুরি হনহন করে হেঁটে চলে গেল। নিবিড় বিস্মিত হল। এই বিত্তবান লোকটিকে তার কাছে অকারণেই অদ্ভুত মনে হল।
নিবিড় নিজের ঘরে ঢুকে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে নিজেকে দেখছিল৷ মশালের আলোয় তার বুকের পশমগুলো চিকচিক করছিল। অনেকগুলো বছর আগে যখন এই পশমগুলো গজাতে শুরু করেছিল তখন সুমন তার বুকে চুমু খেয়ে বলত,
-বুকে পশম রাখবে না।
নিবিড় প্রশ্ন করত
-কেন?
উত্তরে সে বলেছিল
-চুমু খাওয়ার সময় মুখে ঢুকে যাবে।
নিবিড় ধাক্কা দিয়ে সুমনকে চিৎ করে শুয়ে দিয়ে তার বুকে চড়ে তার বুক পশমে দাঁত দিয়ে কামড় দিয়ে বলত
-তাহলে, মিঃ এইগুলো? ফেলে দেই?
তারা হাসত৷ তাদের হাসিতে ইশ্বরের হিংসে হত। তাই তাদের ভাগ্য মুছে, পরস্পরকে আলাদা করে নতুন করে যে ভাগ্য লিখল তাতে কেউ ই কারো না।
রাতে মইনের ঘুম হয়নি। সকাল সাতটার দিকে জেগে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল। তার ভেতরটাই কেমন জানি উদাসীনতা।মনে হল এই একাকিত্বের, নিসঙ্গতার পরিবর্তন হওয়া দরকার।ইচ্ছে ছিল গোসাইপুর যাওয়ার কিন্তু কী মনে করে যেন গেলো না। হয়তো কারো প্রতি আসক্ত হওয়ার ভয়ে অথবা ভিন্ন কোন কারনে।
নিবিড় ক্লাস নিচ্ছিল। দপ্তরি কাকা এসে বলল তাকে কেউ ডাকছে৷ নিবিড় ক্লাস থেকে বের হয়ে এল।অফিস রুমে ঢুকার আগ পর্যন্ত তার মনে হয়নি যে, তার জন্য জীবনের আরো একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। নীল রঙের শাড়ী পড়ে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে জৈনিক ভদ্র মহিলাকে দেখে সে ভেবেছিল, হবে হয়ত কোন শিক্ষার্থীর অভিবাবক। নিবিড় চেয়ারে বসতে বসতে বলল
-আসুন, বসুন।
ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল
-কেমন আছেন?
-ভাল। কিন্তু আপনি?
-আমাকে চেনার কথা না।
-কেন?
-সেসব থাক।সকালে খেয়েছিলেন?
-জি। কী খাবেন বলুন৷
-কী খাওয়াতে পারবেন?
-গ্রাম্য এলাকা। সাধ্যের মধ্যে যা আছে। তবে পরিচয়টা জানা থাকলে সুবিধে হত।
-আমি মিতু। একটা কলেজে রসায়ন পড়াচ্ছি।আপনাকে দেখার অভিপ্রায় থেকে এখানে আসা।
-হঠাৎ,আমার মত গুণহীন কারো ব্যপারে আগ্রহের কারন টা ঠিক বোধগম্য হল না।
-কারন তো অনেকগুলা ই আছে। তবে সেই কারনগুলা তুলা থাক। আমি আজ উঠি।
-সে কি? আসার হেতু না বলেই উঠবেন।
-হ্যা,উঠব। আবার দেখা হচ্ছে৷ খুব দ্রুত৷
মিতু উঠে বাহিরের দিকে বের হয়ে গেল। নিবিড় তাকিয়ে রইল৷ এই অদ্ভুত মহিলাটিকে তার কাছে বিস্ময় মনে হচ্ছিল।
ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে মেঘনা ফুসে উঠল। প্রবল বাতাস শুরু হল। বোর্ড অফিস হতে ঐ পাড়ে আসতে না আসতেই শুরু হল বর্ষণ। সাথে সাথে বাতাস। ভয়ানক ঝড়ে নৌকা প্রায় ডুবে যাওয়ার উপক্রম। চড়ে আসার পর বর্ষণ আরো প্রবলতর হল। সাথে বাতাসের ঝাপ্টা। গাছগুলো মড়মড় করে ভাঙতে লাগল। নিবিড় নৌকা থেকে নেমে নৌকাটা খুটিতে বেধে দ্রোত হাটতে লাগল। বিপরীত মুখি বাতাসের ধাক্কায় সামনের দিকে আগানোর সুযোগ নেই।তারুপরে চড়ের উড়ন্ত বালি। নিবিড়ে পড়নের পাঞ্জাবীটা খোলে মাথায় বেধে ফেলল। আর পকেট থেকে রুমালটা খোলে চোখ মুখ চেপে ধরল। কবরস্থানের দিক দিয়ে যাওয়ার সময় যখন গাছের ডাল এসে উড়ে মাথায় পড়ার উপক্রম ঠিক সেই সময় পিছন থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ডালটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে আকাশে বিজলি চমকালো। সেই আলোতে নিবিড় এমন একজনের চেহারা দেখল যাকে সে ভুলার জন্য এতটা সংগ্রাম করে আসছে।নিবিড় উঠে দাঁড়াল শক্ত হয়ে। সুমনের কন্ঠস্বর ভেসে আসল।
-ব্যথা পাননি তো?
নিবিড় উত্তর না দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।সুমন এগিয়ে এল। সুমন যখন নিবিড়ের ঠিক পাশে তখন আবার বিদ্যুৎ চমকালো। সেই বিদ্যুতের আলো সুমনের জীবন আলোকিত করার পথ দেখাল। আজ এত দিন পর যে মানুষটাকে একটিবার দেখার জন্য ছটফট করেছিল সে তার সামনে দাঁড়িয়ে।সুমন বাকরুদ্ধ। নিবিড়ের চোখে চোখ পড়তেই আনন্দে তার হৃদয়ে বিদ্যুৎ চমকাল। সে নিবিড়ের হাতটা টেনে ধরে বলল
-নি নি নিবিড়৷ আমি তোমায় অনেক খোঁজেছি। নিবিড়।
নিবিড় শব্দ করেনি। যে হাতটা সুমন তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল তা প্রত্যাখ্যান করে দৌড়ে চলে গেল। সুমন এই ঝড় বৃষ্টির রাতে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। এত দিনের কষ্ট আজ তার লাগব হল।
সে ভিজে বাসায় গেল। অহনা আর মিতু গভীর চিন্তায় ছিল৷ তাকে দেখে চিন্তামুক্ত হল। আজ অনেক দিন পর সুমনের ঠোটের কোণায় হাসি দেখে মিতু প্রশান্তির নিশ্বাস নিল। মানুষটাকে হাসলে সত্য ই সুন্দর লাগে।
নিবিড় রুমে এসে কাঁপতে লাগল। ঝড় থেমে গেছে।কিন্তু নিবিড়ের বুকে যে ঝড় উঠেছে তা থামার নাম নেই। নিবিড়ে বাহিরে এসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। নিরব এই চরে তার কান্না, যন্ত্রনা শুনার মত কেউ নেই৷ সে অসহায়৷ একা৷ সে নির্জন। নিরব।ইশ্বর কী চায়, কী তার খেলার ফলাফল তা কেবল ইশ্বর ই জানে।
..............চলবে.............
শূণ্যস্থান-৩
Reviewed by সমপ্রেমের গল্প
on
June 14, 2019
Rating:
শূন্যস্থান-৪ এর অপেক্ষায় থাকবো।
ReplyDeletePlz next part Post korun
ReplyDeleteশূন্যস্থান 8 অপেক্ষায় আছি
ReplyDelete